সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩৫ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর সীমান্তে সীমান্তে লাশের সংখ্যা বেড়েই চলেছে : রিজভী কুলাউড়ায় দুই সহোদরের উদারতায় এলাকাবাসী পেল যাতায়াতের রাস্তা মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের প্যারেড ও মাসিক কল্যাণ সভা অনুষ্ঠিত কুলাউড়ায় ২ শতাধিক বন্যার্ত পরিবারের মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ কুলাউড়ায় দুর্গাপুজা উপলক্ষে বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করলেন জেলা পুলিশ সুপার দেশে ফিরলেন মিজানুর রহমান আজহারী সাবেক এমপি সুলতান মনসুর ৫ দিনের রিমান্ডে কুলাউড়ায় পুলিশের অভিযানে ২ ডাকাত আটক কানাডা থেকে দেশে ফিরেই বিমানবন্দরে আটক সাবেক এমপি সুলতান মনসুর সাবেক কৃষিমন্ত্রীর ভাই চেয়ারম্যান বদরুল যৌথবাহিনীর হাতে আটক

বুয়েটে হচ্ছেটা কি!

মাহফুজুর রহমান
  • আপডেট : শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৪

বুয়েটে কি চলছে? বুয়েটে কি হলো? বুয়েটের কোনো খোঁজ কি রাখছেন? কদিন ধরে আমাকে এরকম অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি বুয়েটের ছাত্র ছিলাম। বুয়েটে থাকাকালীন সময়ে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বুয়েট ছেড়েছি প্রায় পয়ঁত্রিশ বছর আগে। লম্বা সময়। নানা কারণে বুয়েটে কি হচ্ছে বা হয় তার হালনাগাদ খবরাখবর আমার কাছে থাকে না। প্রয়োজনও পড়ে না। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কারণে বুয়েট যখন পত্রিকার শিরোনামে আসে তখন অন্যান্য খবরের মতো সে খবরে চোখ বুলাই। হয়তো মনের কোণে কিছুটা আবেগ কাজ করে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। দেশের অন্যত্র খবরের কোনো অভাব নেই। ফলে বুয়েটের খবর অল্প একটু আবেগের সৃজন ছাড়া অতিরিক্ত কিছু করে না। বুয়েটের ছাত্র রাজনীতি নিয়েও এখন আর অতি আবেগ কাজ করে না। তবে আলমা মেটার বলে কথা। ব্যতিক্রমও আছে। যখন খবরের কাগজে বুয়েট চার কলাম জায়গা দখল করে, তাও ছাত্র রাজনীতির কারণে, তখন তা আমার মনে তা আট কলাম জায়গা করে নেয়।

 

এমনটি হয়েছিল আবরার ফাহাদের হত্যা খবরে। বাংলাদেশে অনেক অসম্ভব ঘটনা ঘটে। নিছক ছেলে-ধরা সন্দেহে এক মা-কে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলে। বাস ড্রাইভারকে ঘাতক মনে করে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেলে আটক থেকে মরতে হয়। ভিন্ন মত ধারণ করে সন্দেহে একজন ছাত্রকে তার সহপাঠিরা পিটিয়ে মারে। এবং তা কিনা বুয়েটে? এবং শেরে বাংলা হলে? এই হলেই কিনা আমি ছিলাম! এই হলের ছাত্র সংসদে একসময় নির্বাচিত হয়েছিলাম। এই হলকে টেলিভিশন বিতর্ক সহ আরো নানা জায়গায় প্রতিনিধিত্ব করেছি। সন্তানদের কাছে এই হল নিয়ে গর্ব করতাম। ছাত্রজীবন শেষে এই হলের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেছি। আবরার ফাহাদের হত্যা কি স্বাভাবিক ঘটনা! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন, ছাত্র রাজনীতি কিংবা সাধারণ কোনো ছাত্র কি এর দায় এড়াতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবেও আমরা যে দায় এড়াতে পারছি না।

 

পঁয়ত্রিশ বছর আগের গল্প এখন বলে কোনো লাভ নেই। কি লাভ এখন বলে যে র‍্যাগ কি জিনিস আমরা দেখিনি। কেমন শোনাবে যদি বলি ছাত্র রাজনীতিতে এমন সহিংসতা বুয়েটে ছিল না। হাস্যকর শোনাবে যদি বলি ছাত্র রাজনীতিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মূল্যবান প্রাপ্তি! এই ক বছরে পলাশী বা বখশিবাজারের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ বদলেছে। ছাত্রসমাজ বদলেছে। নতুন প্রজন্ম এসেছে। ছাত্র রাজনীতিও বদলে গেছে।

 

মানব জাতি সামনে এগোয়। সভ্যতাও তাই। কৌশলগত কারণে দু কদম এগুনোর জন্য কখনো কখনো এক কদম পেছাতে হয়। কিন্তু আমরা যে শত কদম পিছিয়ে গেছি, তা সাম্প্রতিক শত শত ঘটনা সাক্ষ্য দিচ্ছে। আমি জেনে অবাক হয়েছিলাম যখন বুয়েট কর্তৃপক্ষ আবরার-হত্যা পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে সামরিক শাসন আরোপ করার মতো ঘটনা এটি। সামরিক শাসকদের বয়ান এমনই হতো। রাজনৈতিক কলহ চলছে – দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত – ফলে জানমাল রক্ষার্থে সামরিক শাসন জারি একমাত্র সমাধান। বুয়েটও তাই করেছে। রাজনীতির নামে, নিজের দু-পয়সা লাভের বিনিময়ে, সব রকম অনিয়ম ও অনাচারকে প্রশ্রয় দিয়ে শেষে নিজের পিঠ বাঁচাতে খড়গটা চালিয়েছে ছাত্র রাজনীতির উপর। কেন? উপাচার্য, হল প্রভোস্ট বা ছাত্র কল্যাণ পরিচালকদের কেউ কি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে সরে আসতে পারতেন না। যাঁরা বুয়েটকে অন্যতম মহান বা শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ মনে করেন তাঁরা কেউ কি এমনটা উপদেশ দিয়েছিলেন। সংকটকালেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ আসে। শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় উদাহরণের মাধ্যমে। বুয়েটের প্রশাসন, ছাত্র, শিক্ষক, ছাত্র সংগঠন, এমনকি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন – প্রত্যেকে সেই সংকটে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারেননি।

 

এ অতি আশ্চর্যের যে এখন ছাত্রদের একটা অংশ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। এ পর্যায়ে হয়তো তা অধিকাংশের অভিমত। গবেষকরা এর চল্লিশটা কারণ বের করতে পারবেন। সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থা তাদের মতো করে কারণ খুঁজবেন। কিন্তু বুয়েট তো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ না। আমাদের সমাজের সর্বস্তর থেকে বুয়েটে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে। সারা বাংলাদেশ থেকে। চার-পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে এই ছাত্র-ছাত্রীরাই আবার পেশাদার হিসেবে সেই একই সমাজে আত্মীকৃত হয়। সুতরাং বুয়েটের কোনো সমস্যা একান্ত বুয়েটের সমস্যা না। বুয়েটের কোনো সংকট কেবল বুয়েটের সংকট না।

 

সংকট! ছাত্র রাজনীতি কি কোনো সমস্যা না সংকট! ছাত্র রাজনীতির প্রতি অনীহা কি কোনো সংকট? আমি ভিন্নভাবে দেখতে চাই। বুয়েটে যে অচলাবস্থা বা পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান দেখা যাচ্ছে তা আসলে উপসর্গ মাত্র। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের অংশগ্রহণ দিন দিন কমছে। রাজনীতি, নির্বাচন – একদা এসব উৎসব ছিল। এখন উলটো। কারো জন্য উৎসব হলেও অনেকে তাতে পিঠ দেখায়। কারণ, রাজনীতি বা নির্বাচন সবার জন্য আর উৎসব নেই। সবাইকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্মাণের বদলে আমরা কেবল বিভাজনেই আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রির একটা উক্তি আমার খুব পছন্দ হয়। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। কি সুন্দর অন্তর্ভুক্তিমূলক কথা! এরকম কথা তো রাজনীতির বেলায়ও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

 

আমি বুয়েট জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করতাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলাম। অথচ আমার রুমমেটদের একজন কখনো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। অন্য দুজন ভিন্ন দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। রাজনীতির কারণে আমাদের মধ্যে কখনো কোনো মনোমালিন্য , ঝগড়া বা মারামারি হয়নি। ভিন্ন ভিন্ন দলের মিছিল করে ফিরে এসে আমরা একসঙ্গে ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে যেতাম। বছর পাঁচেক আগে বুয়েটের একটা রোবোটিকস দলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। পাঁচ জনের দল। দলনেতা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। অন্যরা তাঁর জুনিয়র। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম দলনেতাই সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমী। সেই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এমনকি গায়ে খাটুনির কাজগুলো যেগুলো অন্যরা সহজেই করতে পারতো, দলনেতা নিজে সেগুলোও অবলীলায় করছে। দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সামনে থেকে। ওখানে কোনো র‍্যাগিং নেই, সিনিয়র বলে ছড়ি ঘুরানো নেই। দলনেতা হয়েছে কর্মে উদাহরণ তৈরি করে।

 

গত চার বছর বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ছিল না। কিন্তু সেখানে পঞ্চাশটির মতো ক্লাব সক্রিয় ছিল। ছাত্র রাজনীতি নাই বলে যাঁরা অসুখী ছিলেন তাঁরা এসব ক্লাবে সক্রিয় হতে পারতেন। নেতৃত্বে আসতে পারতেন। সামরিক শাসনামলে যখন রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংগঠনের উপর খুব কড়াকড়ি ছিল, তখন আমরা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে নিজেদের সংগঠিত করেছি। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ছিল।

 

রাজনীতি বিমুখ জাতি সামনে এগুতে পারে না। তবে সে রাজনীতি ভিন্ন কারো প্রেসক্রিপশনে সচল হতে পারে না। রাজনীতির ক্ষুধা আসতে হবে ভেতর থেকে। নিজস্ব তাগিদে। অনুভব করতে হবে এই সত্য যে নিজের বাঁচার প্রয়োজনে, একসঙ্গে সামনে চলার প্রত্যয়ে, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য, নিজের পেশাগত উৎকর্ষতার জন্য, ন্যায় ও মুক্তির জন্য, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতির বিকল্প নেই। আপনার রাজনীতিতে অন্য কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেবেন না। আপনি নিজে অন্য কারো রাজনীতির ঘুঁটি হবেন না।

 

লেখক মাহফুজুর রহমান
সাবেক রাষ্ট্রদূত

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন
© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২০ | কেবিসি নিউজ ফ্রান্স
Theme Developed BY NewsFresh